ঢাকা ০৫:৪৮ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২৫ অক্টোবর ২০২৪, ১০ কার্তিক ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

বাড়িঘর ছেড়ে মুসাফির বেশে গ্রামের পর গ্রাম হেঁটে দিচ্ছেন দ্বীনের দাওয়াত

বয়স প্রায় সত্তরের দরজায়। জীর্ণশীর্ণ দেহ নিয়ে এখনো তিনি হেঁটে চলেন গ্রামের পর গ্রাম। বয়সের ভার এখনো যাকে করতে পারেনি নিস্তেজ। শয়তানের ধোঁকাও শেষ বয়সের লক্ষ্য আর উদ্দ্যেশ্য থেকে পথভ্রষ্ট করতে পারেনি তাকে। বলছিলাম চাঁদপুরের মতলব উত্তর উপজেলার প্রবীণ শিক্ষাগুরু নূর মোহাম্মদ স্যারের কথা।

Model Hospital

দীর্ঘ চল্লিশ বছর ছিলেন শিক্ষকতার মতো মহান পেশায়। জীবনের পড়ন্ত বিকেলে নিজের স্বপ্নকে পূরণ করতে তিনি ছেড়েছেন বাড়িঘর। কালো একটি কাঁধব্যাগে মহাগ্রন্থ কোরআন ও হাদীস শরীফসহ পবিত্র বিভিন্ন বই নিয়ে বহু ক্রোশ হেঁটে হেঁটে গ্রামাঞ্চলের অসংখ্য মসজিদে দ্বীনের দাওয়াতে খেদমত করে যাচ্ছেন তিনি।

উপজেলার সিকিরচর গ্রামের পশ্চিমপাড়া আন-নূর জামে মসজিদে বয়ানে আসলে কথা হয় তারই এই ছাত্রের (প্রতিবেদক) সাথে। জানালেন তার শিক্ষাজীবন থেকে শুরু করে দীর্ঘ এই যাত্রার কথা।

১৯৫৬ সালের ১লা সেপ্টেম্বর চাঁদপুরের মতলব উত্তর উপজেলার ছেংগারচর পৌরসভার কেশাইরকান্দি গ্রামের সম্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন মরহুম কালু ছৈয়ালের একমাত্র পুত্র নূর-মোহাম্মদ। বৈবাহিক জীবনে ছয় মেয়ে ও এক ছেলের জনক তিনি। নিজের একমাত্র ছেলেকেও বানিয়েছেন হাফেজ। পুত্র হাফেজ জসিম উদ্দিন ইমামতি করেন।

শিক্ষাজীবনে ১৯৭১-৭২ সালে ঐতিহ্যবাহী ফরাজিকান্দি উয়েসীয়া কামিল মাদ্রাসা থেকে ফাজিল (তফসীর) ও ১৯৭৯ সালে কামিল সম্পন্ন করেন।

এরপর একই বছরে ১৯৭৯ সালে শরীফ উল্লাহ উচ্চ বিদ্যালয়ে ধর্মীয় শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন তিনি। একটানা চলতে থাকে তার শিক্ষকতা জীবন। সর্বশেষ ২০১৬ সালের আগস্টে অবসরে যাওয়ার পর খন্ডকালীন আরো ৩ বছর বেসরকারী ভাবে দায়িত্ব পালন করে শিক্ষকতা জীবনের ৪০ বর্ষ পূর্ণ করেন শিক্ষার এই বাতিঘর।

দীর্ঘ এই ক্যারিয়ারে একই ঘরের বাবা-মা-ছেলে-নাতীন পর্যন্ত এভাবে জেনারেশনের পর জেনারেশন পাঠদানের মতো বহু রেকর্ড রয়েছে শিক্ষক নূর-মোহাম্মদের।

তাই যেখানেই যান না কেন, কোন না কোন শিক্ষার্থীর সাথে দেখা হয়েই যায় তার এবং তাকে দেখে অতি আপ্লুত হয়ে পড়েন শিক্ষার্থীরা। একইসাথে বিনম্রচিত্তে সালাম ও শ্রদ্ধা বিনিময়ও করেন তারা। প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের আতিথেয়তা ও আন্তরিকতার এমন নিদর্শনকে দীর্ঘ জীবনের অর্জন হিসেবে মনে করেন এই শিক্ষাগুরু।

আলাপকালে মহাগ্রন্থের বিভিন্ন আয়াত উদ্ধৃতি দিয়ে শিক্ষক নূর-মোহাম্মদ বলেন, দাওয়াতে দ্বীন ইসলামের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি কাজ। পবিত্র কুরআন শরীফে মহান রাব্বুল আলামিন ইরশাদ করেন, ‘তোমরা শ্রেষ্ঠ উম্মত, মানবজাতির কল্যাণের জন্য তোমাদের পাঠানো হয়েছে। তোমাদের দায়িত্ব হচ্ছে তোমরা সৎ কাজের আদেশ করবে এবং নিষেধ করবে মন্দ কাজ থেকে’ (সূরা ইমরান-১)।

মানবজীবনে ইসলামের অস্তিত্ব নির্ভর করে দাওয়াতি কাজের ওপর। আল্লাহ তায়ালা যুগে যুগে যত নবী-রাসূল পাঠিয়েছেন তাঁদের সবারই দায়িত্ব ছিল মানুষের কাছে ইসলামের দাওয়াত পৌঁছে দেয়া।

দাওয়াত দানের নির্দেশ দিয়ে মহান আল্লাহ বলেন, ‘তুমি তোমার পালনকর্তার দিকে (মানুষকে) আহবান করো। আর তুমি অবশ্যই মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত হবে না’ (ক্বাছাছ ২৮/৮৭)। তিনি আরো বলেন, ‘হে নবী বলুন! এটিই আমার পথ। আমি এবং আমার অনুসারীগণ ডাকি আল্লাহর পথে জাগ্রত জ্ঞান সহকারে (সুস্পষ্ট দলীল সহকারে)। আল্লাহ মহা পবিত্র। আর আমি মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত নই’ (ইউসুফ ১২/১০৮)।

তিনি আরও বলেন, প্রয়োজনীয় দ্বীন শিক্ষা সবাইকে দেওয়া মুসলিম মাত্রই জরুরি। ইসলামী আকীদা-বিশ্বাস, কুরআন তিলাওয়াত, অযু, নামায, যাকাত, রোযা, হজ্বের প্রয়োজনীয় মাসায়েল, হালাল-হারামের বুনিয়াদী বিষয়সমূহ, ইসলামী আদব-আখলাক, দ্বীনের বোধ ও চেতনা, দ্বীনের প্রতি দরদ ও মহব্বত প্রভৃতি বিষয় সকলের জানা আবশ্যক।

এ শিক্ষা এজন্য জরুরি যে, এতে সে ধীরে ধীরে দ্বীনমনষ্ক ও ইসলামীবোধসম্পন্ন হয়ে উঠতে পারবে। ঈমান ও তাকওয়ার চেতনায় উজ্জীবিত হবে। জীবনাচরণে ন্যায় ও সততার পরিচয় দিতে সক্ষম হবে। দায়িত্ববান ও সুনাগরিক হিসেবে গড়ে উঠতে পারবে। এই শিক্ষা সাধারণ শিক্ষায় শক্তি সঞ্চার করবে, আলো ছড়াবে। এর সুফল বয়ে আনতে সহায়তা করবে। প্রয়োজনীয় দ্বীনী ইলম ও বোধ সবসময় জরুরি। বর্তমানে অনেক বেশি জরুরি। এখন বিপথগামিতার উপায়-উপকরণ ও হাতছানি অতীতের চেয়ে বেশি। ওসব উপকরণ এখন বাইরের জগৎ পেরিয়ে চার দেয়ালের ভেতরেও ঢুকে পড়েছে।

উল্ল্যেখ্য, পারস্য মহাকবি শেখ সাদী (রহঃ)’র পথকে অনুসরন করে চলছেন তিনি। ইসলাম ও দ্বীনের প্রচারে মসজিদে মসজিদে প্রতিনিয়ত বয়ান করেন তিনি। রাসুল (সাঃ) এর আদর্শে আল্লাহর বানী নিয়ে হেঁটে চলেছেন আর এভাবেই বাকিটা জীবন ইসলাম প্রচারে এভাবেই কাজে লাগিয়ে শেষ নিশ্বাস ছাড়তে চান তিনি।

সময়ের কণ্ঠস্বর

ট্যাগস :
জনপ্রিয় সংবাদ

ঘূর্ণিঝড় দানা: চাঁদপুর থেকে সব রুটে লঞ্চ চলাচল বন্ধ

বাড়িঘর ছেড়ে মুসাফির বেশে গ্রামের পর গ্রাম হেঁটে দিচ্ছেন দ্বীনের দাওয়াত

আপডেট সময় : ০৩:০৮:৫১ অপরাহ্ন, সোমবার, ২৬ ডিসেম্বর ২০২২

বয়স প্রায় সত্তরের দরজায়। জীর্ণশীর্ণ দেহ নিয়ে এখনো তিনি হেঁটে চলেন গ্রামের পর গ্রাম। বয়সের ভার এখনো যাকে করতে পারেনি নিস্তেজ। শয়তানের ধোঁকাও শেষ বয়সের লক্ষ্য আর উদ্দ্যেশ্য থেকে পথভ্রষ্ট করতে পারেনি তাকে। বলছিলাম চাঁদপুরের মতলব উত্তর উপজেলার প্রবীণ শিক্ষাগুরু নূর মোহাম্মদ স্যারের কথা।

Model Hospital

দীর্ঘ চল্লিশ বছর ছিলেন শিক্ষকতার মতো মহান পেশায়। জীবনের পড়ন্ত বিকেলে নিজের স্বপ্নকে পূরণ করতে তিনি ছেড়েছেন বাড়িঘর। কালো একটি কাঁধব্যাগে মহাগ্রন্থ কোরআন ও হাদীস শরীফসহ পবিত্র বিভিন্ন বই নিয়ে বহু ক্রোশ হেঁটে হেঁটে গ্রামাঞ্চলের অসংখ্য মসজিদে দ্বীনের দাওয়াতে খেদমত করে যাচ্ছেন তিনি।

উপজেলার সিকিরচর গ্রামের পশ্চিমপাড়া আন-নূর জামে মসজিদে বয়ানে আসলে কথা হয় তারই এই ছাত্রের (প্রতিবেদক) সাথে। জানালেন তার শিক্ষাজীবন থেকে শুরু করে দীর্ঘ এই যাত্রার কথা।

১৯৫৬ সালের ১লা সেপ্টেম্বর চাঁদপুরের মতলব উত্তর উপজেলার ছেংগারচর পৌরসভার কেশাইরকান্দি গ্রামের সম্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন মরহুম কালু ছৈয়ালের একমাত্র পুত্র নূর-মোহাম্মদ। বৈবাহিক জীবনে ছয় মেয়ে ও এক ছেলের জনক তিনি। নিজের একমাত্র ছেলেকেও বানিয়েছেন হাফেজ। পুত্র হাফেজ জসিম উদ্দিন ইমামতি করেন।

শিক্ষাজীবনে ১৯৭১-৭২ সালে ঐতিহ্যবাহী ফরাজিকান্দি উয়েসীয়া কামিল মাদ্রাসা থেকে ফাজিল (তফসীর) ও ১৯৭৯ সালে কামিল সম্পন্ন করেন।

এরপর একই বছরে ১৯৭৯ সালে শরীফ উল্লাহ উচ্চ বিদ্যালয়ে ধর্মীয় শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন তিনি। একটানা চলতে থাকে তার শিক্ষকতা জীবন। সর্বশেষ ২০১৬ সালের আগস্টে অবসরে যাওয়ার পর খন্ডকালীন আরো ৩ বছর বেসরকারী ভাবে দায়িত্ব পালন করে শিক্ষকতা জীবনের ৪০ বর্ষ পূর্ণ করেন শিক্ষার এই বাতিঘর।

দীর্ঘ এই ক্যারিয়ারে একই ঘরের বাবা-মা-ছেলে-নাতীন পর্যন্ত এভাবে জেনারেশনের পর জেনারেশন পাঠদানের মতো বহু রেকর্ড রয়েছে শিক্ষক নূর-মোহাম্মদের।

তাই যেখানেই যান না কেন, কোন না কোন শিক্ষার্থীর সাথে দেখা হয়েই যায় তার এবং তাকে দেখে অতি আপ্লুত হয়ে পড়েন শিক্ষার্থীরা। একইসাথে বিনম্রচিত্তে সালাম ও শ্রদ্ধা বিনিময়ও করেন তারা। প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের আতিথেয়তা ও আন্তরিকতার এমন নিদর্শনকে দীর্ঘ জীবনের অর্জন হিসেবে মনে করেন এই শিক্ষাগুরু।

আলাপকালে মহাগ্রন্থের বিভিন্ন আয়াত উদ্ধৃতি দিয়ে শিক্ষক নূর-মোহাম্মদ বলেন, দাওয়াতে দ্বীন ইসলামের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি কাজ। পবিত্র কুরআন শরীফে মহান রাব্বুল আলামিন ইরশাদ করেন, ‘তোমরা শ্রেষ্ঠ উম্মত, মানবজাতির কল্যাণের জন্য তোমাদের পাঠানো হয়েছে। তোমাদের দায়িত্ব হচ্ছে তোমরা সৎ কাজের আদেশ করবে এবং নিষেধ করবে মন্দ কাজ থেকে’ (সূরা ইমরান-১)।

মানবজীবনে ইসলামের অস্তিত্ব নির্ভর করে দাওয়াতি কাজের ওপর। আল্লাহ তায়ালা যুগে যুগে যত নবী-রাসূল পাঠিয়েছেন তাঁদের সবারই দায়িত্ব ছিল মানুষের কাছে ইসলামের দাওয়াত পৌঁছে দেয়া।

দাওয়াত দানের নির্দেশ দিয়ে মহান আল্লাহ বলেন, ‘তুমি তোমার পালনকর্তার দিকে (মানুষকে) আহবান করো। আর তুমি অবশ্যই মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত হবে না’ (ক্বাছাছ ২৮/৮৭)। তিনি আরো বলেন, ‘হে নবী বলুন! এটিই আমার পথ। আমি এবং আমার অনুসারীগণ ডাকি আল্লাহর পথে জাগ্রত জ্ঞান সহকারে (সুস্পষ্ট দলীল সহকারে)। আল্লাহ মহা পবিত্র। আর আমি মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত নই’ (ইউসুফ ১২/১০৮)।

তিনি আরও বলেন, প্রয়োজনীয় দ্বীন শিক্ষা সবাইকে দেওয়া মুসলিম মাত্রই জরুরি। ইসলামী আকীদা-বিশ্বাস, কুরআন তিলাওয়াত, অযু, নামায, যাকাত, রোযা, হজ্বের প্রয়োজনীয় মাসায়েল, হালাল-হারামের বুনিয়াদী বিষয়সমূহ, ইসলামী আদব-আখলাক, দ্বীনের বোধ ও চেতনা, দ্বীনের প্রতি দরদ ও মহব্বত প্রভৃতি বিষয় সকলের জানা আবশ্যক।

এ শিক্ষা এজন্য জরুরি যে, এতে সে ধীরে ধীরে দ্বীনমনষ্ক ও ইসলামীবোধসম্পন্ন হয়ে উঠতে পারবে। ঈমান ও তাকওয়ার চেতনায় উজ্জীবিত হবে। জীবনাচরণে ন্যায় ও সততার পরিচয় দিতে সক্ষম হবে। দায়িত্ববান ও সুনাগরিক হিসেবে গড়ে উঠতে পারবে। এই শিক্ষা সাধারণ শিক্ষায় শক্তি সঞ্চার করবে, আলো ছড়াবে। এর সুফল বয়ে আনতে সহায়তা করবে। প্রয়োজনীয় দ্বীনী ইলম ও বোধ সবসময় জরুরি। বর্তমানে অনেক বেশি জরুরি। এখন বিপথগামিতার উপায়-উপকরণ ও হাতছানি অতীতের চেয়ে বেশি। ওসব উপকরণ এখন বাইরের জগৎ পেরিয়ে চার দেয়ালের ভেতরেও ঢুকে পড়েছে।

উল্ল্যেখ্য, পারস্য মহাকবি শেখ সাদী (রহঃ)’র পথকে অনুসরন করে চলছেন তিনি। ইসলাম ও দ্বীনের প্রচারে মসজিদে মসজিদে প্রতিনিয়ত বয়ান করেন তিনি। রাসুল (সাঃ) এর আদর্শে আল্লাহর বানী নিয়ে হেঁটে চলেছেন আর এভাবেই বাকিটা জীবন ইসলাম প্রচারে এভাবেই কাজে লাগিয়ে শেষ নিশ্বাস ছাড়তে চান তিনি।

সময়ের কণ্ঠস্বর