সংস্কৃতি মানব জীবনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। জীবন ও সাংস্কৃতি নিবিড়ভাবে সম্পর্কিত। মানুষের জাগতিক নৈপুণ্য ও কর্মকুশলতা, বিশ্বাস, আশা-আকাঙ্ক্ষা, কলা ও নৈতিকতা, রাজনীতি, ভাষা, সাহিত্য ও মূল্যবোধ সবকিছুই সংস্কৃতির অন্তর্ভুক্ত। আমাদের সংস্কৃতি হাজার বছর ধরে বাঙালি জীবনবোধের ওপর গড়ে উঠেছে। কিন্তু সাম্প্রতিক বিশ্বায়নের কারণে ভিন্ন সংস্কৃতির অনুপ্রবেশ আমাদের এ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের মূলে কুঠারাঘাত করেছে। আমাদের তরুণ সমাজ চটকদার এ সংস্কৃতির প্রতি প্রবলভাবে আকৃষ্ট হচ্ছে। ভিন্ন সংস্কৃতির অন্ধ মোহে পড়ে তাদের জীবনচেতনা, মূল্যবোধ বিনষ্ট হতে চলেছে। তাদের পোশাক-আশাক, চালচলন, ভাষা ও খাদ্যাভ্যাস প্রভৃতি ভিন্ন সংস্কৃতি দ্বারা প্রভাবিত হচ্ছে। অপসংস্কৃতির ছোবল আমাদের তরুণ সমাজকে আদর্শচ্যুত করে তাদেরকে অপরাধপ্রবণ করে তুলছে।
আমাদের তরুণ সমাজকে অপসংস্কৃতির মরণ ছোবল থেকে রক্ষা করতে হবে। এক্ষেত্রে দেশীয় সংস্কৃতি ধারণ করে বিদেশি সংস্কৃতির ভালো দিকটি গ্রহণ করতে হবে। শিক্ষা ও সভ্যতার অবনতি ঘটিয়ে যে সংস্কৃতি মানুষকে সুন্দর আদর্শ থেকে দূরে সরিয়ে দেয়– তাই অপসংস্কৃতি। এক অর্থে সংস্কৃতির বিকৃত রূপই হলো অপসংস্কৃতি, যা আমাদের মনকে কলুষিত করে, জীবনকে বিকৃত করে, মূল্যবোধকে ধ্বংস করে। বিদেশি সংস্কৃতিকে আমরা একবাক্যে অপসংস্কৃতি হিসেবে আখ্যা দিয়ে থাকি। কিন্তু আমাদের এ ধারণা সঠিক নয়। কেননা, বিদেশের সবকিছুই অপসংস্কৃতি নয়। তবে বিদেশি যে সংস্কৃতি আমাদের জীবনবোধ ও বিশ্বাসকে কলুষিত করে, জীবনকে বিকৃত করে দেয় তাকেই আমরা অপসংস্কৃতি বলব।
আমাদের তরুণ সমাজ বিদেশিদের মতো পোশাক-আশাক পরে নাচ-গান করে অনিয়ন্ত্রিত জীবনকে অনুসরণ করে অতি আধুনিক হওয়ার চেষ্টায় মরিয়া হয়ে উঠেছে– এই অবক্ষয়জনিত প্রচেষ্টা থেকে তাদেরকে রক্ষা করতে হবে। কেননা, আজকের তরুণরাই দেশের ভবিষ্যৎ। কিন্তু অপসংস্কৃতি তাদের মূল্যবোধ নষ্ট করে জীবনকে অন্ধকার গহ্বরের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। ফলে সত্য ও সুন্দরকে বিসর্জন দিয়ে তারা উগ্র জীবনবোধে মাতাল হয়ে উঠছে। সিনেমা, টেলিভিশন, ইন্টারনেটের অসংগতিপূর্ণ অশালীনতার ছোবলে তরুণসমাজ আজ বিভ্রান্ত। এ থেকে তরুণ সমাজকে উদ্ধার করতে না পারলে আমাদের সামাজিক সুস্থ পরিবেশ তলিয়ে যাবে অপসংস্কৃতির অতল গহ্বরে। শুধু তরুণরাই নয়, এই অপসংস্কৃতির ভয়াবহ প্রভাব পড়ছে শিশু-কিশোরদের ওপরও। ফলে দিন দিন আমরা হাজার বছরের দেশীয় ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে হারাতে বসেছি।
আমাদের দেশে দিন দিন কিশোর অপরাধ বাড়ছেই। চুরি, ছিনতাই ও মাদকসেবন থেকে শুরু করে ধর্ষণের মতো ঘটনাও ঘটছে তাদের দ্বারা। এই অপসংস্কৃতি মানুষের নৈতিক মূল্যবোধকে ধ্বংস করে দিচ্ছে, ফলে সমাজের সবখানেই দুর্নীতি, সুদ, ঘুষ, মিথ্যাচার, প্রতারণা ও স্বার্থপরতা বাড়ছে। এটা নিঃসন্দেহে তাদের অনিশ্চিত ভবিষ্যতেরই প্রতিচ্ছবি। মানুষ ঠিক-বেঠিকের মাঝে পার্থক্য করতে অক্ষম হয়ে পড়ছে। দেশীয় সংস্কৃতি চর্চা না করার কারণে, বর্তমানে অপসংস্কৃতি তরুণ প্রজন্মের সুন্দর ও স্বাভাবিক বিকাশের পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। অপসংস্কৃতির ছোঁয়ায় দেশীয় সংস্কৃতি এখন তরুণ প্রজন্মের কাছে অপছন্দনীয়। তাই তরুণ সমাজকে অপসংস্কৃতির হাত থেকে বাঁচাতে হলে অচিরেই আমাদের সমাজ থেকে অপসংস্কৃতির প্রভাব দূর করতে হবে এবং শিক্ষিত সমাজকে সচেতন ও সোচ্চার হতে হবে। আমাদের তরুণসমাজকে বিকশিত করতে হলে সুষ্ঠু পরিবেশ গড়ে তুলতে হবে।
পাশাপাশি তাদের বিকাশের জন্য প্রয়োজন অনুকূল সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিবেশ। অপসংস্কৃতির অবাধ প্রবেশকে ঠেকাতে হবে সুস্থ সংস্কৃতি দিয়ে। বিদেশি সংস্কৃতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়ার আগে বিবেচনা করতে হবে– আমাদের জন্য তা উপযোগী কিনা। যদি উপযোগী না হয় তবে তার প্রচলন রোধ করতে হবে। তরুণরাই অনিয়মের বিরুদ্ধে সোচ্চার। তাই তাদের জন্য প্রয়োজন সঠিক ও সুস্পষ্ট পথনির্দেশনা। কারণ তরুণরা নিজে নিজে বিকশিত হতে গেলেই পথভ্রষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। আমাদের নিজস্ব ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির আলোকে তাদেরকে আলোকিত করে তুলতে হবে। অপসংস্কৃতির ছোবল থেকে তরুণসমাজকে রক্ষা করতে হলে এর বিরুদ্ধে প্রবল সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।
তরুণরাই দেশ ও জাতির প্রাণ। সমাজ ও রাষ্ট্রের মূল চালিকাশক্তি। আগামীর বিশ্ব তথা দেশ গড়ার কারিগর। তরুণ সমাজই পারে আগামী দিনের পৃথিবীকে আরো সুন্দরতর করে তুলতে। একটি দেশের সভ্যতা, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি কতদূর এগিয়ে যাবে, সেটা তাদের ওপরই নির্ভর করে। তাই তাদের বিপথগামিতা রোধ করা অপরিহার্য একটি বিষয়। তাদেরকে জাতীয় জীবন ও সংস্কৃতির প্রতি আগ্রহী করে তুলতে হবে। অপসংস্কৃতি যেন আমাদের সমাজকে বিনষ্ট করতে না পারে সে জন্য সরকারি পদক্ষেপ এবং অভিভাবকদের পাশাপাশি তাদের রক্ষার জন্য সব শ্রেণির মানুষকেই সচেতন হতে হবে। আমাদের মনে রাখতে হবে বাঙালি সংস্কৃতিতেই আমাদের প্রকৃত পরিচয় নিহিত। আমরা আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতির অনুসরণ করেই সব অপসংস্কৃতির জোয়ার রোধ করতে পারব।
লেখক: মোঃ রনি, শিক্ষার্থী বিবিএ (অনার্স) হিসাববিজ্ঞান বিভাগ, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় অধিভুক্ত, রামগঞ্জ মডেল কলেজ, লক্ষ্মীপুর।
