শেখ হাসিনা আবারও তার দল ও নেতাকর্মীদের বিপদের দিকে ঠেলে দিলো। শেখ হাসিনাকে মূল্যায়নে আওয়ামী লীগ ও দলের নেতাকর্মীরা ব্যর্থ হলে ভবিষ্যতে তাদেরকে আরও বিপদে পড়তে হতে পারে, তা নিশ্চিত। গণহত্যার দায়ে আওয়ামী লীগ রাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে ভবিষ্যতে রাজনীতি করার সুযোগ পাবে কিনা তা এক বিরাট প্রশ্ন। পৃথিবীর কোনো দেশেই গণহত্যাকারী দল ও ব্যক্তিদের পুনর্বাসিত হওয়ার নজির নেই। এতকিছুর পরও আওয়ামী লীগ ইস্যুতে যখন কিছুটা নমনীয় অবস্থা বিরাজ করে তখনই শেখ হাসিনা দানব চেহারা নিয়ে হাজির হয়। ৫ আগস্টের পরও তার স্বভাবগত জিঘাংসা, প্রতিহিংসা ও প্রতিশোধের বিকৃত মানসিকতা প্রকাশ পাচ্ছে। বাংলাদেশ ও জনগণের আকাঙ্খাবিরোধী বক্তব্য, মন্তব্য সামনে আসছে। একারণে বিপ্লবী ছাত্র-জনতাও বারবার রাজপথে নেমে আসছে।

দেড় দশকের বেশি সময়ে গুম-খুন, বিনাবিচারে হত্যার শিকার প্রায় হাজার হাজার মানুষ। বিরোধী মত-পথের ৭৫ লাখ লোকের বিরুদ্ধে মামলা দিয়ে ঘরছাড়া, কর্মহারা করে ব্যক্তি ও পরিবারের জীবন তছনছ করা হয়েছিলো। সর্বশেষ জুলাই আগস্টের একুশ দিনে প্রায় দেড় হাজার (জাতিসংঘের ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং রিপোর্ট মতে) ছাত্র-জনতাকে গণহত্যা করা হলো। দুই হাজার লোককে পঙ্গু ও অন্ধ করা হলো। প্রায় ১২ হাজার হাজার লোককে গুলি, ধারালো অস্ত্রের আঘাতে আহত করে জনরোষে শেখ হাসিনাকে ক্ষমতা ছেড়ে পালাতে হলো। পলাতক হাসিনা এখন ভারতের আশ্রয়ে-প্রশ্রয়ে মাঝে মাঝেই গর্ত থেকে মাথা বের করে মুলত তার নেতাকর্মীদের বিপদকে আরও বাড়িয়ে তুলছে।
আজীবন ক্ষমতায় থাকার লালসায় শেখ হাসিনা বাবা শেখ মুজিবুর রহমানের মতো অঘোষিত বাকশাল কায়েম করেছিলো। একনায়ক, স্বৈরাচার ও ফ্যাসিস্ট হয়ে উঠেছিলো। এর পেছনে ভারতের প্রেসক্রিপশন এবং আস্কারা ছিলো। সর্বশেষ ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারির ডামি নির্বাচন ভারতের সমর্থনে সম্পন্ন হয়। তার আগে ২০১৪ সালের বিনা ভোট এবং ২০১৮ সালের রাতের ভোটও এভাবে সম্পন্ন করে আওয়ামী লীগ সরকার। সুতরাং বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব ও জনগণের অধিকার বিষয়ে ভারতের অবস্থান আমাদের কাছে স্পষ্ট। ভারতের সমর্থনে গণহত্যাকারী শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগ দাঁড়াতে চাইলে দেশের মানুষ তা গ্রহণ করবে না। ভারত একজন গণহত্যাকারীকে আশ্রয় দেয়ার পর তাকে রাজনৈতিক স্পেস দিয়ে তৎপরতার সুযোগ দেয়ার মানে বাংলাদেশের মানুষ ও বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার শামীল।
আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের উচিত শেখ হাসিনাসহ দেশ থেকে পালাতক সকল নেতাকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করা। তাদের নির্দেশনা না মানার সুস্পষ্ট ঘোষণা দেওয়া। অযাচিত ক্ষমতা ভোগ করে বিরোধীদের দমন-পীড়ন করা নেত্রী ও দলের শীর্ষ নেতারা নিজেদের বাঁচাতে গা ঢাকা দিয়েছে। দেশ ছেড়ে পালিয়েছে। অথচ সাধারণ নেতাকর্মীদের বিপদের মুখে রেখে গেছেন। সেই নেত্রী, নেতাদের কোনো কথা, নির্দেশনা না মানার ঘোষণা দিয়ে আপনারা গণহত্যার বিচার চান, গণতন্ত্র হরণের বিচার চান, ভোট ব্যবস্থা ধ্বংসকারীদের বিচার চান, নির্যাতন সেল আয়না ঘর প্রতিষ্ঠাকারীদের বিচার চান। গায়েবি মামলা, নির্যাতন-নিপীড়ণকারীদের বিচার চান। এসব বিষয়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ নেতা, কর্মী ও সমর্থকদের একাত্মতা প্রকাশ করা সমীচীন বলে মনে করি।

আর বিপ্লবী ছাত্র-জনতার প্রতি পরামর্শ, ফ্যাসিস্টদর বিভিন্ন স্থাপনার প্রতি ক্ষোভ ঝাড়া সমাধান নয়। আসল কাজা করেন, আসল আওয়াজ তোলেন। বাংলাদেশকে ভারত ডিস্টার্ব করছে। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তা তুলে ধরতে সরকারকে বলূন। দিল্লি বাংলাদেশের জন্য নিরাপত্তাঝুঁকি হয়ে উঠেছে তা বিশ্বকে জানান। ড. ইউনুস সরকারের ফরেন পলিসি যারা ঠিকঠাক (মেইনটেইন) করেন সেই দপ্তরের কর্তা-ব্যক্তিদের এই বিষয়ে তৎপর হওয়া বাঞ্চনীয়।
অনস্বীকার্য বাংলাদেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির স্বাভাবিক বিকাশ এবং গণতান্ত্রিক উম্মেষ সাধনের অন্তরায় ভারত। বাংলাদেশের সমৃদ্ধি, অগ্রগতি ও প্রগতি বাধাগ্রস্ত করাই ভারতের কাজ। এর পেছনে অনেকগুলো কারণ আছে। এই আলাপ আজ নয়। হাজার হাজার লোকের গণহত্যাকারী, হাজার হাজার লোকককে পঙ্গু, অন্ধ, আহত করে জনরোষের শিকার শেখ হাসিনা ক্ষমতা ছেড়ে ভারতে পালিয়েছেন। এই খুনি, পলাতককে আশ্রয় দেয়ার পর এখন তাকে রাজনীতি করার স্পেস দিয়ে মুলত ভারত বাংলাদেশের গণহত্যাকে লেজিটিমেসি দিচ্ছে। হাসিনার গণহত্যা নিয়ে ভারত এখনও চুপ। অথচ ৩২ ভাঙা নিয়ে দিল্লির তড়িৎ উদ্বেগ, বিবৃতি মুলত ফ্যাসিবাদকে বৈধতা দেয়ার সিম্বল।
এখন ভারতের মুল উদ্দেশ্য মুলত দুটি- এক. শেখ হাসিনা এবং আওয়ামী লীগকে দিয়ে বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল রাখা। দুই. শেখ হাসিনা এবং তার দলকে পুনর্বাসন করে আবারও বাংলাদেশকে করদরাজ্য বানানো। ভারতের জন্য দেড় দশকের বেশি সময় সোনার ডিমপাড়া হাসিনা ও আওয়ামী লীগ উৎখাত হওয়ায় দ্বিগভ্রান্ত দিল্লি আসলে বাংলাদেশ ইস্যুতে তাদের করণীয় ঠিক করতে এখনও হুঁশ ফেরাতে পারিনি। তাই একদিকে তাদের গুজব মিডিয়াকে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দিয়েছে, অন্যদিকে দিল্লির কর্তৃপক্ষ হাসিনা ও তার পলাতক নেতাদের রাজনৈতিক কার্যক্রম চালানোর স্পেস দিয়ে বাংলাদেশ বিরোধী তৎপরতার সুযোগ করে দিচ্ছে। শুধু তাই নয়, হিন্দুত্ববাদী দিল্লির সরকার বৈশ্বিক অঙ্গনে বাংলাদেশকে এবং বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার ও আওয়ামী লীগ বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোকে সাম্প্রদায়িক, জঙ্গি গোষ্ঠীর পরিচিতি দেয়ার মিশন চালাচ্ছে। গত ১৩ ফেব্রুয়ারি হোয়াইট হাউজের ওভাল অফিসে ট্রাম্প-মোদির সাক্ষাতে বাংলাদেশ প্রসঙ্গ এবং জুলাই বিপ্লব নিয়ে ভারতীয় সাংবাদিকের উস্কানিমুলক প্রশ্ন এবং তার সূত্র ধরে গদি মিডিয়ার প্রপাগান্ডা তা-ই নির্দেশ করছে।
এবার আসি, আওয়ামী লীগ নিয়ে দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর সিদ্ধান্তহীনতার বিষয়ে। এমনকি গণহত্যার শিকার শহীদ ও আহত, পঙ্গু, অন্ধ হওয়া লোকদের অমূল্য ত্যাগের সিঁড়ি বেয়ে যে অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় তারাও আওয়ামী লীগ নিয়ে সিন্ধান্তহীনতায়। গণহত্যাকারী, ফ্যাসিস্ট দল ও তাদের দোসরদের নিষিদ্ধ এবং বিচার চায় ছাত্র-জনতা। সরকার এবং সকল রাজনৈতিক শক্তি এই বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছা জরুরি। এর ব্যত্যয় ঘটলে ভবিষ্যতে আরও বড় ফ্যাসিবাদের উত্থানের পথকেই আমরা প্রশস্ত করে যাবো। পঁচাত্তর, নব্বই ও চব্বিশ জ্বলন্ত উদাহরণ। সুতরাং আমরা কি বারবার পশ্চাতপদতার দিকে হাটবো? নাকি ভবিষ্যত স্থিতিশীলতাকে এগিয়ে নেবো। স্বৈরাচার, ফ্যাসিবাদী ও গণতন্ত্র হরণের শত্রুদের পথরোধের সিদ্ধান্ত ও ব্যবস্থা এখনই নিতে হবে। আজ আওয়ামী লীগ দায়মুক্তি পেলে কাল আওয়ামী লীগ নয়, অন্য কারো ফ্যাসিবাদী লীগ হয়ে উঠার খায়েস অবাস্তব নয়।
তাই বলছি, ফ্যাসিস্টদের স্থাপনা নিয়ে ক্ষোভ প্রদর্শন সমাধান নয়, আসল কাজ করুন। বাংলাদেশবিরোধী প্রফাগান্ডার বিষয়ে ভারতকে জোরালো বার্তা দেন, বৈশ্বিক দৃষ্টি আকর্ষণ করুন। আওয়ামী লীগের ভবিষ্যত রাজনীতি নিয়ে ছাত্র-জনতার সঙ্গে সকল রাজনৈতিক শক্তির ঐকমত্য পৌঁছাও জরুরি।
জাকির মজুমদার
সাংবাদিক ও সংগঠক
Jm.bd1979@gmail.com