বাংলাদেশ একটি মধ্যম আয়ের দেশ। এ দেশের যারাই ধনবান আছে একমাত্র তারা ছাড়াই বাকি সবাই কষ্টে আছে। মূল্যস্ফীতির কারণে ভয়াবহ প্রভাব পড়েছে নিম্ন আয়ের মানুষের ওপর। চাপের মধ্যে আছেন মধ্য আয়ের মানুষ। খুব টানাপোড়েনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে সংসার যাদের আয় স্বল্প। জমানো অর্থে হাত দিতে হচ্ছে অনেকের। উপায় নেই বলে সঞ্চয় ভেঙে সংসার চালাতে হচ্ছে নিম্ন আয়ের মানুষদের। শহরে জীবন সংগ্রামে টিকতে না পেরে পরিবারকে গ্রামে পাঠিয়ে দিচ্ছেন এমন সংবাদ পাওয়া যায় দেশের গণমাধ্যমে। বাজার নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছে বেশ আগেই! বাজার দর মিল পাওয়া যায় না স্থানভেদে। একই পণ্য স্থানভেদে দাম ভিন্ন! ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেটে বন্দি পুরো দেশ।
নিয়ন্ত্রণ কার হাতে? জানে না কেউ। মাঝেমধ্যে অভিযান পরিচালনা করে ভোক্তা অধিকার অধিদপ্তর এমন খবর দেখা যায় টেলিভিশন চ্যানেল বা পত্র পত্রিকা কিংবা ফেসবুকে। যা যৎসামান্য। এ অভিযানে জনগণের কী ফয়দা হয় তা জানি না তবে জরিমানার অর্থ সরকারি কোষাগারে জমা হয়। দেশে আয় যেভাবে বাড়ছে, তার চেয়ে বেশি বাড়ছে ব্যয়। এর মধ্যে সব ধরনের নিত্যপণ্যের দাম লাগামহীন। ফলে দাম বাড়ার বাড়তি প্রতিযোগিতার চাপে পিষ্ট সাধারণ মানুষ। জীবনযাত্রার ব্যয় মেটাতে নাভিশ্বাস অবস্থা। নিত্যপণ্যের দাম বাড়ছে লাগামহীনভাবে। সাধারণ একটি সংসারে খাওয়ার জন্য দিনে যা লাগে, তার বেশির ভাগের দামই চড়া। কোনো পণ্যের দাম হঠাৎ কয়েকগুন বাড়ে। কিন্তু কমার সময় সামান্য কমে। এতে মূল্যস্ফীতি বাড়ছে। শ্রমজীবী মানুষের অবস্থা দিন দিন খারাপ হচ্ছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) বলছে, শ্রমিকদের মজুরি হার বাড়ছে। অর্থাৎ যেহারে আয় বেড়েছে বাজারে জিনিসপত্রের দাম তার চেয়ে বেশি বেড়েছে।
চাল, ডাল–তেলের মতো আটা, চিনি, ব্রয়লার মুরগি, গরুর মাংস, গুঁড়া দুধ, রসুনসহ বেশ কিছু নিত্যপণ্যের দাম বৃদ্ধিতে চাপে পড়েছেন স্বল্প আয়ের মানুষ। সাধারণ মানুষের একমাত্র ভরসার জায়গা সবজি ও ফলমূল। সেগুলোতেও হাত দেয়া যাচ্ছে না উচ্চ দামের কারনে। এই সাধারণ মানুষগুলো মাছ মাংসের স্বাদ না নিলেও ডাল- সবজি দিয়ে দু মুঠো ভাত খাবেন, সেটাও যেন হচ্ছে না এখন। কোন সবজির দাম বর্তমানে ৬০-৭০ টাকার নিচে না। নিত্যপণ্যের ঊর্ধ্বগতিতে দিশেহারা সাধারণ মানুষ। জিনিসপত্রের দাম বাড়লেও সে তুলনায় বাড়েনি সাধারণ মানুষের আয়। চাকরিতে বেতন বাড়ে না মাসে মাসে কিন্তু পণ্যের দাম দিনদিন বেড়েই যাচ্ছে। কাটছাঁট করে কষ্ট করে টেনেটুনে চলছে নিম্ন মধ্যবিত্তের সংসার। মাসিক ২৫-৩০ হাজার টাকা আয় দিয়েও তিন সদস্যের পরিবারের সংসার চালানো দায় হয়ে পড়েছে শহরে বাস করা বাসিন্দাদের। সরকারের উন্নয়নের প্রচার দেখা যায় গণমাধ্যম কিংবা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে। সেখানে চাল উৎপাদন কিংবা মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বে দশের ঘরে থাকে। তবে কেন মাছের দাম তিনশ’র ঘরে? চাল কেন সত্তর টাকা কেজি? আমদানিতে কর কি বেশি নিচ্ছে সরকার? উৎপাদন বেশি হলে দাম নাগালের সাধ্যে থাকার কথা। পুষ্টিবিদদের মতে দৈনিক দেড়শ থেকে দুইশ গ্রাম ফল থাকা জরুরি খাদ্য তালিকায়। বাজারে তিনশ টাকার নিচে ফল পাওয়া যায় না! দেশি ফল তাও দুইশ টাকার আশপাশে। কঠিন চাপের মধ্যে আছেন মধ্য আয়ের মানুষ। এ মুহূর্তে মূল্যস্ফীতি ও বাজার নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে আরও কঠিন হয়ে পড়বে সাধারণ মানুষের জীবন।
এদিকে সবজির দাম বৃদ্ধি হওয়ায় হতাশ ক্রেতা সাধারণ। গত ১ মাসে সব ধরনের সবজির দামও কেজিতে বেড়েছে ২০ থেকে ৩৫ টাকা। সাধ্যের মধ্যে সবজি কিনতে না পারায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন মধ্য ও নিম্নআয়ের মানুষজন। ব্যবসায়ীরা বলছেন, বাজারে শীতের সবজি না আসায় দাম তুলনামূলক ভাবে একটু বেশি। তবে শীতকালীন সবজি বাজারে উঠলে দাম কমে যাবে। চড়া দামে কাঁচা তরিতরকারি কিনতে গিয়ে নাভিশ্বাস উঠে যাচ্ছে সাধারণ ক্রেতাদের। সবজি ক্রেতারা বলেন, আজ অনেকদিন ধরে একই রকম ভাবে বাজারে বাড়তি দামে সবজি বিক্রি হচ্ছে। দাম কমার লক্ষণ দেখছি না। যেখানে এক কেজি সবজি কিনব, সেখানে প্রকারভেদে আধা কেজি ও ২৫০ গ্রাম কিনতে হচ্ছে। সাধ্যের মধ্যে না থাকায় অনেক ক্রেতা একই ভাবে সবজি কিনে বাড়ি ফিরছেন। সিন্ডিকেট আড়তদারদের কারণেই বাজারে দাম বেশি। বাজার সহনীয় অবস্থায় নেই। এতো দাম দিয়ে সবজি কিনতে হবে বুঝে উঠতে পারছি না। আগের তুলনায় প্রতি কেজি সবজি প্রায় ২০ থেকে ৩৫ টাকা বেশিতে কিনতে হয়েছে। সবমিলিয়ে বলতে গেলে বাজারে সবজির দাম বাড়তিই যাচ্ছে। সবজি বিক্রেতারা বলেন, গত প্রায় ১৫ দিন ধরে সবজির বাজার একই রকম যাচ্ছে। বাজারভেদে কোনো কোনো সবজির দাম ১৫-২০ টাকা কম-বেশি হয়। পাইকারি বাজার থেকে মাল কেনার পর খাজনা ও পরিবহন খরচ হয়। সে কারণে লাভ রেখে ক্রেতাদের কাছে বিক্রি করি। তবে শীত মৌসুম না হওয়ায় কিছু কিছু সবজির বাড়তি দাম যাচ্ছে। এর কারণ হলো বাজারে সরবরাহ খুবই কম তাই দাম একটু বাড়তি। অন্যদিকে পূজার কারনে বর্ডার বন্ধ থাকায় কাঁচামালের কিছু সংকট দেখা দিয়েছে। আর এমন যদি কাঁচাবাজারের দৃশ্য, তাহলে সাধারণ যাবে কোথায়?
এদিকে সরকারি-বেসরকারি সংস্থার জরিপে দেখা গেছে, এক বছরে মানুষের দৈনন্দিন ব্যয় ১০ শতাংশের বেশি বেড়েছে। বিপরীতে আয় বেড়েছে মাত্র ৪ থেকে ৬ শতাংশ। ফলে তাদের আয় ও ব্যয়ের মধ্যকার ব্যবধান বেড়েছে গড়ে ৬ শতাংশ। দেখা যায়, নিত্যপণ্যের দাম বৃদ্ধির পাশাপাশি বেড়েছে বাসা ভাড়া, ছোট বড় সকল যাতায়াত ভাড়া। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বেতন ও কোচিং সেন্টারের খরচসহ সন্তানের লেখাপড়ার খরচ বেড়েছে পাল্লা দিয়ে। লেখাপড়ার খরচের মধ্যে ভর্তি ফি এখন অনেক অভিভাবকের জন্যই বোঝা। একই সঙ্গে স্কুলের বেতন বেড়েছে ব্যাপক হারে। সেই সাথে এক বছর ধরে অব্যাহতভাবে বাড়ছে ওষুধের দাম। একই সঙ্গে চিকিৎসকের ফি, ল্যাবরেটরি টেস্টের খরচ বেড়েছে। ফলে এক বছরে চিকিৎসা ব্যয় ২০ শতাংশের বেশি বেড়েছে। তাই এখনই সকল নিত্যপণ্যের লাগাম টেনে ধরা দরকার বলে মনে করি।
প্রবন্ধকার ও লেখক
চাঁদপুর সদর।