মোঃ মাসুদ রানা : চাঁদপুরের শাহরাস্তিতে “জয়িতা অন্বেষণে বাংলাদেশ” শীর্ষক কার্যক্রমের আওতায় ২০২১ সালে বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে ৫ জয়িতাকে সম্মাননা প্রদান করা হয়েছে।

পুরুষশাসিত সমাজে নানা বৈষম্য ধরুন অনগ্রসর, বিভিন্ন ক্ষেত্রে নির্যাতনের বিভীষিকায় তিমিরে লুকিয়ে থাকা নারীরা যেভাবে সফলতার সিঁড়ি বেয়ে বেঁচে থাকার পথ খুঁজে পেয়েছেন। তাদের ওই জীবন-যুদ্ধের অজানা গল্প সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের কর্তা ব্যক্তিরা খুঁজে এনে তাদের যথার্থ মূল্যায়নে এ আয়োজন করেন। ওই হিসেবে গত বৃহস্পতিবার (৯-ডিসেম্বর) উপজেলা প্রশাসন এবং মহিলা বিষয়ক অফিসের আয়োজনে পরিষদ মিলনায়তনে তাদেরকে এ সম্মাননা প্রদান করা।
ওইদিন উপজেলা নির্বাহী অফিসার ও বিজ্ঞ নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট শিরীন আক্তারের সভাপ্রদানে ভার্চুয়াল প্রোগ্রামের টেলিকনফারেন্সে প্রধান অতিথি হিসেবে যুক্ত ছিলেন সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি মেজর অব. রফিকুল ইসলাম বীর উত্তম এমপি।
এ বিষয়ে শাহরাস্তি উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা আবদুল আউয়াল খন্দকার জানায়, ‘‘নারী নির্যাতন বন্ধ করি, ‘‘কমলা রঙ্গের বিশ্ব গড়ি, এ প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে অত্র উপজেলায় বেগম রোকেয়া দিবস ও আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ পক্ষ উপলক্ষে ৫ নারী জয়িতাকে সংবর্ধনা শেষে তাদের সম্মাননার পুরস্কার এবং সনদ হাতে তুলে দেয়া হয়েছে।
এক্ষেত্রে সমাজ উন্নয়নে অসামান্য অবদান রাখার স্বীকৃতি স্বরূপ পুরস্কৃত ওই সংগ্রামী আলোচিত নারীদের একজন জান্নাতুল ফেরদাউস। তিনি উপজেলার সুচিপাড়া উত্তর ইউপি’র সুচিপাড়া গ্রামের আনোয়ার হোসেনের স্ত্রী। লক্ষ্মীপুর জেলার রামগঞ্জ উপজেলায় শিশু কালটা কাটিয়ে কিশোরীতে পা রাখতেই তার পরিবারের সদস্যরা সংসারে অভাবের বাহানা তুলে শাহরাস্তিতে বিয়ে দিয়ে দেয় তাকে। অপরিণত বয়সে এখানে এসে তিনি মনস্থির করলেন, তাকে বিদ্যা অর্জন করে স্বাবলম্বী হতে হবে। তারপর তিনি স্বামীর বাড়িতে টিউশনির অর্থকড়ি দিয়ে নিজের শিক্ষা জীবন শুরু করেন। এক এক করে বিএসএস বিএড ডিগ্রি অর্জন করে একটি সপ্রাবি’র প্রধান শিক্ষক হিসেবে বর্তমানে কর্মরত রয়েছেন। বর্তমানে তিনি প্রতিষ্ঠিত হয়ে নিজের কষ্টের উপলব্ধি থেকে সমাজ উন্নয়নে একটি ক্ষুদে ডাক্তার টিম, শিশু ও মার স্বাস্থ্য সচেতনতায় ক্যাম্পেইন, নারী নির্যাতন ও প্রতিরোধ এবং বাল্যবিবাহ, দুর্যোগকালীন স্কাউট লিডার হিসেবে করোনা আক্রান্তদের পাশে দাঁড়ানোর মতো মানবিক কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছেন। এদিকে নিজের বড় মেয়েকে জাহাঙ্গীরনগর ইউনিভার্সিটি এবং ছোটটিকে স্থানীয়ভাবে পাঠ গ্রহণ করাচ্ছেন।
আরেকজন নারী নাসিমা আক্তার। তিনি উপজেলার সুচিপাড়া উত্তর ইউপি’র সুচিপাড়া গ্রামের একজন বাসিন্দা ও মৃত মোঃ ফয়জুল আলমের স্ত্রী। জীবন সংগ্রামে পথ চলতে গিয়ে অর্থনৈতিকভাবে সফলতা ঠিকানা খুঁজে পেয়েছেন তিনি । ২০১৮ সালে স্বামী হারিয়ে পরিবার-পরিজন নিয়ে অর্থনৈতিক অনটনে দু’মুঠো অন্ন জোগারে কঠিন পরিস্থিতি সামাল দিতে হয় তাকে। ওই অবস্থা থেকে উত্তরণে তিনি উপজেলার যুব উন্নয়ন অফিস থেকে সেলাই প্রশিক্ষণ নিয়ে পোশাক তৈরি এবং বিক্রি অবশেষে নিজেকে সেলাই ট্রেইনার হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে ভাগ্য বদলের চাবিকাঠি খুঁজে পান। বর্তমানে তিনি পুঁজি শূন্য অবস্থাকে গুডবাই জানিয়ে ৩ লক্ষ টাকা মূলধন সৃষ্টি করে প্রতি মাসে প্রায় ৩০হাজার টাকা রোজগার করছেন। বর্তমানে দুই সন্তান নিয়ে ভালোই দিন কাটছে তার।
পারভিন আক্তার শিক্ষা ও চাকরি ক্ষেত্রে সাফল্য দেখিয়েছেন এ নারী। তিনি উপজেলার চিতোষী পশ্চিম ইউপির সিমাইল হড়িয়া গ্রামের জহিরুল ইসলামের স্ত্রী। জীবনের শুরুতে দরিদ্র পরিবারের অধিবাসী হওয়া সত্বেও নিজেকে আলোকিত করতে টিউশনির অর্থে এসএসসি পাস করেন। পরে উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এইচএসসি সনদ নিয়ে প্রথমে একটি কমিউনিটি প্রাথমিক স্কুল পরে অন্য সপ্রাবিতে সরকারি চাকরি জুটিয়ে নিতে সক্ষম হন। তার এতটা সাফল্যর পেছনে নিয়ামক হিসেবে কাজ করেছে টিউশনি এবং সেলাই কাজের অর্থ।বর্তমানে তিনি সুখেই জীবন যাপন করছেন বলে মনের অভিলাষ ব্যক্ত করেন।
জাহানারা বেগম তিনি দারিদ্রতাকে গুডবাই জানিয়ে নতুন উদ্যমে “সফল জননী” হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছেন । তিনি উপজেলার রায়শ্রী দক্ষিণ ইউপির খিলা মুন্সিবাড়ির নুরুল হক মিয়ার স্ত্রী।জীবনের একটি সময় তার স্বামী ৫ টি সন্তান রেখে দুনিয়া থেকে চলে যান। ওই সময় সংসারের ভার ও পাঁচটি বাচ্চার ভরণপোষণ চলে আসে তার কাঁধে । এরপর তিনি গ্রাম পঞ্চায়েতে বিভিন্ন সমিতি গঠন করে সেখানে সেলাই কাজ শুরু করে অর্থ উপার্জন করেন। পাশাপাশি ব্র্যাকের এনজিওতে খণ্ডকালীন চাকরি জুটিয়ে নেন। পরে ওই প্রাপ্তির উপর ভর করে তার ৫ সন্তানের মধ্যে বড় মেয়েকে বিএ,পাস দ্বিতীয় মেয়েকে অনার্স-মাস্টার্স শেষে (সপ্রাবিতে সরকারি চাকরি) তৃতীয় মেয়ে অনার্স মাস্টার্স, চতুর্থ মেয়ে এসএসসি পরীক্ষার্থী, একমাত্র ছেলেকে বিএসসি পাশ করে বিদেশে পাঠিয়েছেন। বর্তমানে তিনি সুখী এবং স্বাবলম্বী মানুষ।
ছালেহা বেগম যে নারী নির্যাতনের বিভীষিকা মুছে ফেলে নতুন উদ্যমে জীবনকে সমাজে জানান দিতে সক্ষম হয়েছে। ওই সংগ্রামী নারী পৌর শহরের ৮ নং ওয়ার্ডের পাটোয়ারি বাড়ির সুলতান আহমেদের মেয়ে।তিনি ৩সন্তান মেয়ে নিয়ে জীবন শুরু করলেও তার স্বামী হঠাৎ করে মৃত্যুবরণ করেন। পরে ওই কষ্ট সামলিয়ে পরিবারের সিদ্ধান্তে ১ কাঠমিস্ত্রিকে বিয়ে করেন, কিছুদিন যেতেই তার পিতার টাকা দিয়ে স্বামীকে বিদেশ পাঠান। ওই স্বামী স্বাবলম্বী হয়ে হঠাৎ করে ১৪ বছর পূর্বে সে এক নারির সঙ্গে পরকীয়ায় জড়িয়ে ৩টি সন্তান ও স্ত্রীকে রেখে কেটে পড়েন। শুরু হয় তার এবং সন্তানদের বেঁচে থাকার সংগ্রাম। প্রথমে তিনি উপজেলা মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরে সেলাই প্রশিক্ষণ নিয়ে বেত-বাঁশের সামগ্রী কে কাজে লাগিয়ে অর্থ উপার্জন করে সংসারের হাল ধরেন এবং সন্তানদের লেখাপড়া শিখাতে শুরু করেন। তার বড় মেয়েকে এসএসসি পড়িয়ে (বিয়ে দিয়েছেন) দ্বিতীয় মেয়ে এসএইচসিতে লেখাপড়া করাছেন। একমাত্র ছেলেকে মাদ্রাসায় লেখাপড়া চালিয়ে যাচ্ছেন। বর্তমানে তিনি ক্ষুদ্র কুটির শিল্পের ওই প্রশিক্ষণকে কাজে লাগিয়ে একজন উদ্যোক্তা হয়ে ভালই জীবনযাপন করছেন।
এ প্রসঙ্গে উপজেলা নির্বাহি অফিসার শিরীন আক্তার জানান, আমরা অনগ্রসর ক্ষতিগ্রস্ত নারীদের চিহ্নিত করে বিভিন্ন ট্রেডে প্রশিক্ষণ দিয়ে স্বাবলম্বী করে গড়ে তুলছি। এমন কেউ কষ্টের আবদার নিয়ে সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের যোগাযোগ করলে আমরা তাদের সব ধরনের সহযোগিতা করব।