রাফিউ হাসান হামজা : আজ একজন বীরের জন্মদিন। যিনি তার জীবনের অধিকাংশ সময় ব্যয় করেছে এদেশের জনগণের জন্য। আজ তাকে নিয়েই বিস্তারিত প্রতিবেদন।
জন্ম ও শিক্ষাজীবনঃ
রফিকুল ইসলাম ১৯৪৩ সালের ১৩ সেপ্টেম্বরে চাঁদপুর জেলার শাহরাস্তি থানার নাওড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করে। তার বাবার নাম আশরাফ উল্লাহ এবং মায়ের নাম রহিমা বেগম। তিন ভাই ছয় বোনের মধ্যে তিনিই ছিলেন সবার বড়। বাবার চাকুরীসূত্রে শৈশবকাল থেকেই দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে যেয়ে থাকতে হয়েছে যার ফলে পড়াশুনা করতে হয় ভিন্ন ভিন্ন কয়েকটা স্কুলে। নিজ গ্রাম নাওড়াতেই প্রাথমিক স্কুলে হাতেখড়ি। পরে লেখাপড়া করেন পিরোজপুরের ভান্ডারিয়া, গোপালগঞ্জ, ফরিদপুরের পালং, কুমিল্লার চান্দিনা ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। ১৯৫৯ সালে অন্নদা মডেল হাই স্কুল থেকে মেট্রিক পাশ করেন।
কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগে ভর্তি হন। ১৯৮১ সালে তিনি আমেরিকার হার্ভাড বিজনেস স্কুলে সিনিয়র ম্যানেজমেন্ট প্রোগ্রাম কোর্স সম্পন্ন করেন।
কর্মজীবনঃ
বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াকালীন সময়েই রফিকুল ইসলাম সরাসরি জড়িত হয়ে পড়েন ছাত্র আন্দোলনে। আগ্রহ ছিল সাংবাদিকতার প্রতি। সেকারণেই ছাত্রাবস্থাতেই কাজ শুরু করেন ‘ইউপিপি’ সংবাদ সংস্থায়। ১৯৬৩ সালেই যোগ দেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে। পাকিস্তানের কাকুল মিলিটারী একাডেমী থেকে প্রশিক্ষণ লাভের পর ১৯৬৫ সালে সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ারিং কোরে কমিশন পান। পরে তাকে আর্টিলারী কোরে নেয়া হয়। ১৯৬৮ সালে লাহোর ক্যান্টনমেন্ট থেকে তাকে বদলি করে দেয়া হয় পূর্ব পাকিস্তানে। তিনি নিজ রেজিমেন্টসহ যশোর ক্যান্টনমেন্টে রেজিমেন্টের অ্যাডজুট্যান্ট হিসাবে দায়িত্ব পালন শুরু করেন। কিছুদিন পর তাকে ডেপুটেশনে বদলি করা হয় দিনাজপুরে ইপিআর এর ৮ নং উইংয়ের অ্যাসিসটেন্ট উইং কমান্ডার পদে। সেখান থেকে ১৯৭০ সালের প্রথম দিকে ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস্-এর চট্টগ্রাম সেক্টর হেডকোয়ার্টারে অ্যাডজুট্যান্ট পদে পোষ্টিং দেয়া হয়।
সেনাবাহিনী থেকে ১৯৭২ সালের ২৯ এপ্রিল অব্যাহতি পাওয়ার পর কিছুকাল তিনি চট্রগ্রামে সে সময়কার বহুল প্রচারিত ইংরেজি দৈনিক ‘দি পিপলস ভিউ’-র সহযোগী সম্পাদক হিসেবে কাজ করেন। ‘ঢাকা ওয়াসা ‘র চেয়ারম্যান পদে নিয়োগ পেয়ে ১৯৭৭ সাল থেকে ১৯৮১ সালের অক্টোবর মাস পর্যন্ত তিনি সেখানে কর্মরত ছিলেন। তারপর হ্যান্ডলুম বোর্ড -এর চেয়ারম্যান এবং সর্বশেষ বি.আই. ডব্লিউ. টি.সি-এর চেয়ারম্যান হিসেবে ১৯৯০ সালের নভেম্বর পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন।
মুক্তিযুদ্ধে অবদানঃ
১৯৭১ সালে রফিকুল ইসলাম চট্টগ্রামে ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস-এ অ্যাডজুট্যান্ট হিসেবে দায়িত্বরত ছিলেন। সে সময় পশ্চিম পাকিস্তান থেকে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে সেনা সংখ্যা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি, রাজনৈতিক পরিস্থিতির ভয়াবহ অবনতি পর্যবেক্ষণ করে তিনি উপলদ্ধি করেন, যে পাকিস্তানিরা বাঙালিদের বিরুদ্ধে গণহত্যা চালাতে পারে। সেক্ষেত্রে আক্রান্ত হবার আগেই পাকিস্তানিদের উপর আক্রমণ করাই যৌক্তিক- এই ভাবনা থেকে তিনি পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নেন। তদনুযায়ী পহেলা মার্চ থেকে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধের পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি নেয়া শুরু করেন। তিনি তাঁর অধীনস্থ বাঙালি অফিসার ও কয়েকজন বিশ্বস্ত জেসিও, এনসিও-র সাথে যুদ্ধ করার বিষয়ে আলোচনা করেন। একই সময়ে তিনি চট্টগ্রাম অঞ্চলে সেনাবাহিনীতে কর্মরত বাঙালি অফিসারদের সাথে গোপন বৈঠক করে যুদ্ধের জন্যে প্রস্তুতি নিতে তাদের আহবান জানান।
পাকিস্তানি সৈন্যদের জন্য “সোয়াত” জাহাজে আনা প্রচুর অস্ত্র ও গোলাবারুদ খালাস বন্ধ করতে স্থানীয় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সাথে পরামর্শ করেন। সম্মিলিত প্রচেষ্টায় বন্দরের বাঙালি শ্রমিকগণ এবং তাঁর অধীনস্থ বাঙালি সৈন্যরা অস্ত্র, গোলাবারুদ খালাস বন্ধ করে দেয়।
১৯৭১ এর ২৪শে মার্চ রাতেই ক্যাপ্টেন রফিকুল ইসলাম বিদ্রোহ শুরু করেন।গোপন সাংকেতিক বার্তার মাধ্যমে তাঁর আদেশ পেয়ে সীমান্ত ফাঁড়িতে বাঙালি সৈন্যরা অবাঙালি সৈন্যদের নিরস্ত্র ও নিষ্ক্রিয় করে চট্টগ্রাম শহরে এসে প্রতিরোধ যুদ্ধে যোগদানের জন্যে প্রস্তুত হয়। এরই মধ্যে বাঙালি অফিসার কর্নেল এম. আর. চৌধুরী ও মেজর জিয়াউর রহমান সেদিনই যুদ্ধ শুরু করতে সম্মত না হওয়ায় রফিকুল ইসলাম তাঁর ইপিআর এর সৈন্যদের সব সীমান্ত ফাঁড়ি দখল করে যুদ্ধ শুরুর পর চট্রগ্রাম শহরে এসে শহর দখল করার নির্দেশ স্থগিত করেন। কিন্তু পরদিন ২৫শে মার্চ ১৯৭১ তারিখে যুদ্ধ অনিবার্য অনুধাবন করে ক্যাপ্টেন রফিক সশস্ত্র যুদ্ধ শুরু করে দেন এবং ইপিআরের অবাঙালি সৈন্যদের বন্দী করে পুরো চট্টগ্রাম শহর দখলে নিয়ে ফেলেন এবং রেলওয়ে হিলে তাঁর হেডকোয়ার্টার স্থাপন করেন।
২৫শে মার্চ রাতে লেফটেন্যান্ট কর্নেল চৌধুরী ও মেজর জিয়াউর রহমান সময়োচিত পদক্ষেপ নিতে না পারায় ২০ বালুচ রেজিমেন্ট-এর অবাঙ্গালী সৈন্যরা চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্টে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টাল সেন্টার-এর সহস্রাধিক বাঙালি সৈনিক ও অফিসারকে সপরিবারে নৃশংসভাবে হত্যা করে।
মেজর জিয়াউর রহমানের অধীনে ৮ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট এর বাঙালি অফিসার ও সৈনিকরা ষোলশহর এলাকায় তাঁদের ইউনিট লাইন ছেড়ে কালুরঘাট ব্রিজের অপর পাড়ে অবস্থান নেয়। চট্টগ্রামের সীমান্তবর্তী এলাকা থেকে আগত ক্যাপ্টেন রফিকের ইপিআর সৈনিকদের চট্টগ্রামে ইপিআর বাহিনীর সাথে মিলে চট্রগ্রাম শহর দখলে রাখার যুদ্ধে যোগ দিতে না দিয়ে মেজর জিয়াউর রহমান তাঁদেরকে ৮ম ইস্ট বেঙ্গলের সাথে কালুরঘাট ব্রিজ এলাকায় অবস্থান নিতে বলেন। ফলে ক্যাপ্টেন রফিক চট্টগ্রাম সেক্টরের সীমান্ত এলাকায় দায়িত্বে নিয়োজিত বাঙালি সৈন্যদের নিয়ে যুদ্ধ পরিকল্পনার দ্বিতীয় অংশ বাস্তবায়িত্ব করতে পারছিলেন না। সেনাবলের অভাবে চট্টগ্রাম শহরে যথাযথ দখল বজায় রাখতে তিনি সমস্যার সম্মুখীন হন। ব্যাপক সংঘর্ষে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর প্রচুর ক্ষতি সাধন করে ক্যাপ্টেন রফিকের সৈন্যরা মূল প্রতিরক্ষা অবস্থান থেকে সরতে বাধ্য হয়।
পরবর্তীতে রফিক তাঁর বাহিনী নিয়ে চট্টগ্রামের বিভিন্ন অঞ্চলে যুদ্ধ করতে থাকেন। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আর্টিলারি, ট্যাংক ও বিমান আক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় পুরো এপ্রিল মাস যুদ্ধ করতে করতে ১৯৭১ সালের ২রা মে তাঁর হেডকোয়ার্টার রামগড় হতে সীমান্তের ওপারে ভারতের হরিণায় স্থাপন করেন। এখান থেকেই তিনি মেজর হিসেবে পদোন্নতি পেয়ে ১নং সেক্টর কমান্ডার হিসেবে চট্টগ্রাম এলাকায় যুদ্ধ চালিয়ে যান। যুদ্ধের পুরো প্রায় ন’ মাস চট্রগ্রাম অঞ্চলে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ পরিচালনা করেন।
অবশেষে ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে পাকিস্তান বাহিনী পরাজিত হয়ে ঢাকা ও চট্রগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে আত্মসমপর্ণ করলে ১৭ ডিসেম্বর, ১৯৭১ সালে মেজর রফিকুল ইসলাম চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে পাকিস্তানের পতাকা নামিয়ে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন।
স্বাধীনতার জন্য ২৪ মার্চ্ ১৯৭১ সাল থেকে তিনি যুদ্ধ শুরু করেছিলেন। ১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১, পাকিস্তানি বাহিনী আত্মসমর্পন করলে পৃথিবীর মানচিত্রে স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশের অভ্যূদয় ঘটে। নতুন রাষ্ট্রের পতাকা উত্তোলনের মাধ্যমে মেজর রফিক পুরো চট্টগ্রাম-কে মুক্ত করলেন- সফল হলো তাঁর ২৪ মার্চ থেকে বিরামহীন সাহসী যুদ্ধ ।
রাজনৈতিক জীবনঃ
১৯৯০ সালে দেশের প্রথম তত্ত্বাবধায়ক সরকারে তিনি উপদেষ্টা হিসাবে (মন্ত্রী পদমর্যদায়) নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয় এবং বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯৬ সালে তিনি চাঁদপুর জেলার হাজীগঞ্জ-শাহরাস্তি নির্বাচনী এলাকা চাঁদপুর-৫ থেকে সপ্তম জাতীয় সংসদে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব পান। ২০০৮ সালে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে হাজীগঞ্জ ও শাহরাস্তি এলাকা থেকে ২য় বার বিজয়ী হয়ে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত জাতীয় সংসদের স্থায়ী কমিটির সভাপতি নির্বাচিত হন।
২০১৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে একই আসন থেকে তিনি তৃতীয়বারের মতো ১০ম জাতীয় সংসদে নির্বাচিত হয়ে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। ২০১৮ সালে চতুর্থবারের মত একাদশ জাতীয় সংসদেও নির্বাচিত হয়ে আবারও নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সভাপতি পদে এবং ‘মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়’ ও ‘পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়’ সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন।
স্বীকৃতি ও সম্মাননাঃ
বীর উত্তম- ( জীবিত যোদ্ধাদের জন্য সাহসিকতার সর্বোচ্চ পুরস্কার)
বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার (২০১৯)।
মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে রচিত তাঁর মূল গ্রন্থ ” এ টেল অব মিলিয়নস ” বইটি ১৯৭৪ সালে প্রথম প্রকাশিত হয়। ১৯৮১ সালে ” এ টেল অব মিলিয়নস ” বইটিকে পরিবর্দ্ধিত করা হয় এবং একই সময়ে বইটির বাংলা অনুবাদ ” লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে ” প্রকাশিত হয়।
মুক্তিযুদ্ধের সময়কার করুণ ও বেদনাময় কাহিনী নিয়ে রচিত তাঁর আরেকটি বই “মুক্তির সোপানতলে ” প্রকাশিত হয় ২০০১ সালের জুলাই মাসে । বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় সমকালীন বিষয়াদির ওপর তাঁর বেশ কিছু লেখা প্রকাশিত হয়।